যেভাবে ৫০ জিম্মিকে মুক্তি দিতে হামাসকে রাজি করালো ‘গোপন সেল’

আন্তর্জাতিক ডেস্ক •

একটি বিরোধপূর্ণ বৈঠক থেকে বেরিয়ে হোয়াইট হাউজের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক শীর্ষ কর্মকর্তার বাহু আঁকড়ে ধরেছিলেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ঘটনাটি ছিল ১৪ নভেম্বরের। বৈঠকটি ছিল ফিলিস্তিনি হামাস গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি থাকা ২৪০ জনের মুক্তি নিশ্চিত করার বিষয় নিয়ে।

ঘুরে দাঁড়িয়ে ব্রেট ম্যাকগার্ক দেখতে পান ইসরায়েলি নেতা তার দিকে সরাসরি তাকিয়ে আছেন। নেতানিয়াহু বলেন, আমাদের এই চুক্তি প্রয়োজন।

এক সপ্তাহ পর ইসরায়েলি নেতা যা চেয়েছিলেন তা পেয়েছেন।

মঙ্গলবার হামাস ও ইসরায়েলি সরকার ঘোষণা দিয়েছে, তারা দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সমঝোতার বিষয়ে একমত হয়েছে। ৭ অক্টোবর হামাসের হাতে জিম্মি হওয়াদের মধ্য থেকে ৫০ নারী ও শিশুকে মুক্তি দেওয়া হবে।

এদের মধ্যে তিন মার্কিন নাগরিক থাকবেন। যাদের একজন তিন বছর বয়সী মেয়ে আবিগাইল। এই মেয়ের মা-বাবা হামাসের হামলায় নিহত হয়েছেন। ১৫০ ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেবে ইসরায়েল এবং লড়াই চার দিন বন্ধ থাকবে। এই ৫০ জিম্মির বাইরে প্রতি ১০ জনের মুক্তিতে হামলায় বিরতি আরও একদিন করে বাড়বে বলে জানিয়েছে নেতানিয়াহুর কার্যালয়।

ঘোষণার ২৪ ঘণ্টা পর সমঝোতা কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে। কয়েক পৃষ্ঠার এই সমঝোতা চূড়ান্ত হতে বেশ কয়েক সপ্তাহ সময় লেগেছে। এমনকি হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েল সামরিক অভিযান শুরুর আগেই একটি চুক্তি আলোচনার টেবিলে ছিল। এই সমঝোতা চলমান সংঘাতের সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক অগ্রগতি। এমন একটি সমঝোতার প্রত্যাশা করছিলেন বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। তাদের প্রত্যাশা ছিল এমন একটি সমঝোতার মাধ্যমে গাজার ফিলিস্তিনিদের জন্য আরও ত্রাণ সরবরাহ করা যাবে এবং জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।

সমঝোতার ঘোষণা দেওয়ার আগে মঙ্গলবার রাতে এক সিনিয়র মার্কিন কর্মকর্তা বলেছিলেন, আমরা সব জিম্মিকে ফিরিয়ে আনতে চাই। এই সমঝোতার এটি ছিল প্রধান শর্ত।

এই লক্ষ্য পুরোপুরি অর্জিত হয়নি। পুরুষ, ইসরায়েলি সেনা, দ্বৈত ও বিদেশি নাগরিকসহ প্রায় ২০০ জিম্মি এখনও হামাসের জিম্মায় থাকবে। মার্কিন ও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা আশা করছেন, প্রাথমিক মুক্তির পর তাদের অনেককেও ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। তাদের মুক্তির বিষয়ে দরকষাকষি চলমান রয়েছে। মার্কিন কর্মকর্তারা উল্লেখ করছেন, প্রচণ্ড সামরিক চাপে থাকা হামাস জিম্মিদের মুক্তি দিয়ে বিরতিকে কাজে লাগাতে চাইবে।

জিম্মি স্থানান্তর শেষ হলে হামলা শুরু হবে। সমঝোতার ঘোষণার আগে নেতানিয়াহু বলেছেন, আমরা যুদ্ধে লিপ্ত এবং যুদ্ধ চালিয়ে যাবো। আমাদের সব লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ অব্যাহত রাখবো। মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এসব লক্ষ্য পুনরায় তুলে ধরেছে। এর মধ্যে রয়েছে, সব জিম্মিকে মুক্তি, হামাসকে নির্মূল এবং গাজা থেকে ইসরায়েলের জন্য কোনও নতুন হুমকি দেখা না দেওয়া নিশ্চিত করা।

এরপরও ইসরায়েলে হামাসের নজিরবিহীন হামলার পর অন্ধকার সময়ে শুরু হওয়া কূটনৈতিক উদ্যোগ আশার আলো দেখাচ্ছে। বাইডেন প্রশাসনের লক্ষ্য হলো ইসরায়েল ও হামাস কর্তৃক উত্তেজনা বৃদ্ধি না করা এবং আরও জিম্মিকে মুক্তি নিশ্চিত করা।

এক সিনিয়র মার্কিন কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেছেন কীভাবে সমঝোতা চূড়ান্ত হয়েছে। দ্বিতীয় আরেক কর্মকর্তা দরকষাকষির আরও কিছু বিষয় তুলে ধরেছেন মার্কিন সংবাদমাধ্যম পলিটিকোর কাছে। সংবেদনশীল ও উত্তেজনাপূর্ণ কূটনৈতিক উত্তেজনাকর মুহূর্তের কারণে তাদের নাম ও পরিচয় গোপন রেখেছে সংবাদমাধ্যমটি।

৭ অক্টোবর হামলার পর হামাসের ওপর প্রভাব থাকা মার্কিন মিত্র কাতার হোয়াইট হাউজের সঙ্গে যোগাযোগ করে জিম্মিদের বিষয়ে তথ্য নিয়ে। ইসরায়েল ও সারা বিশ্ব তখনও হলোকাস্টের পর সবচেয়ে ভয়াবহ হামলার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। প্রায় ১৫০ জিম্মি সেই হতচকিত অবস্থাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। তাদের মুক্ত করা হয়তো জখমকে কিছুটা প্রশমিত করতো।

কাতার পরামর্শ দেয় জিম্মি ইস্যুতে কাজের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি ছোট সেল গড়ে তোলা দরকার। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান নিজের দুই সেনাপতি, ম্যাকগার্ক ও জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের উপ-সহকারী জশ গেল্তজারের দ্বারস্থ হন। নিজেদের যোগাযোগগুলোর সঙ্গে তারা কাজ করেন এবং হামাসের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছাতে ফোনে সমন্বয় করেন।

১৩ অক্টোবর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ও নিখোঁজ মার্কিন নাগরিক ও জিম্মিদের পরিবারের জুম কলে এর গুরুত্ব নির্ধারিত হয়। নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দীর্ঘ ছিল তাদের আলোচনা। বাইডেন জুম কলে অংশ নেওয়া সবাইকে কথা বলার সুযোগ দেন। প্রথম মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর যেসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমি গেছি, এটি ছিল সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পীড়াদায়ক।

নেতানিয়াহুর সঙ্গে একাধিক ফোনালাপ ও মুখোমুখি বৈঠকে জিম্মি ইস্যুটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে গাজায় মানবিক ত্রাণ প্রবেশ এবং হামাসকে নির্মূল করার অভিযানে বেসামরিকদের নিরাপত্তায় অগ্রাধিকার দিতেও চাপ প্রয়োগ করা হয়।

এসব উদ্যোগ প্রথম সফলতা পায় ২৩ অক্টোবর। দুই মার্কিন নাগরিক নাতালিয়া ও জুডিথ রানানকে মুক্তি দেয় হামাস। এটি প্রমাণ করে গোপন সেলের উদ্যোগ আরও জিম্মির মুক্তি নিশ্চিত করতে পারবে।

একদিন পর হামাস নিজেদের চ্যানেলের মাধ্যমে সেলের কাছে একটি বার্তা পাঠায়, তাতে গাজা ছাড়তে পারবে এমন নারী ও শিশুর সংখ্যা বলা হয়। জটিলতা হলো, তাদের নিরাপদ স্থানান্তর সম্ভব কেবল যদি ইসরায়েল উপত্যকায় স্থল অভিযান পরিচালনা না করে।

দ্বিতীয় মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা ইসরায়েলিদের কঠিন প্রশ্ন করেন। এই সমঝোতাকে একটি সুযোগ দেওয়ার জন্য স্থল অভিযান পেছানো যাবে কিনা। ইসরায়েলিরা অনড় ছিল যে স্থল অভিযান বিলম্বিত করার জন্য শর্তগুলো যথেষ্ট নয়। তখন পর্যন্ত জিম্মিরা জীবিত রয়েছে কিনা তা সম্পর্কে হামাসের পক্ষ থেকে প্রমাণ হাজির করা হয়নি। জিম্মিদের মুক্তির বিষয়ে নিশ্চয়তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েল কোনও চুক্তিতে আসতে রাজি ছিল না।

অক্টোবরের শেষ দিকে ইসরায়েলি সেনারা গাজায় অভিযান শুরু করে। কিন্তু ওই কর্মকর্তা বলেছেন, আক্রমণের পরিকল্পনা এমনভাবে করা হয়েছিল, যাতে যদি কোনও সমঝোতা হয় তাহলে তা অনুযায়ী যেন খাপ খাওয়ানো যায়।

পর্দার আড়ালে একের পর এক কূটনৈতিক উদ্যোগ চলতে থাকে। সমঝোতার মূল বিষয়গুলো ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে আসছিল। হামাস ৫০ জিম্মির তথ্য দেয়। বাইডেনের কাছে ইঙ্গিত যায়, এদের মুক্ত করা সম্ভব। ১৪ নভেম্বর এক ফোনালাপে বিষয়টি নেতানিয়াহুকে অবহিত করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ইসরায়েলি নেতা বাইডেনের সঙ্গে একমত হন।

ওই দিনই পরে ম্যাকগার্কের বাহু আঁকড়ে ধরেছিলেন নেতানিয়াহু। তিনি তাকে বলেছিলেন এই সমঝোতা ইসরায়েলের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ইসরায়েলের জনগণ যুদ্ধের প্রতি সমর্থন জানালেও হামাসের হুমকি থেকে দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারা এবং জিম্মিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থতার জন্য নেতানিয়াহুবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এমন পরিস্থিতিতে জিম্মিদের ফিরিয়ে আনতে শুধু নৈতিক প্রয়োজনীয়তা ছিল না, বরং নেতানিয়াহুর জন্য ছিল রাজনৈতিকভাবে অত্যাবশ্যক।

জটিলতা তখনও ছিল। সামরিক অভিযানের সময় গাজার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় ইসরায়েল। এর ফলে হামাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে তথ্য দেওয়া ও পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। উত্তর গাজায় আল-শিফা হাসপাতালে ইসরায়েলি সেনারা প্রবেশের পর হামাস আলোচনা থামিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। সেল চ্যানেলের মাধ্যমে ইসরায়েল নিশ্চয়তা দেয় তারা হাসপাতাল চালু রাখবে। এই নিশ্চয়তা পাওয়ার পর আলোচনা পুনরায় শুরু হয়। আল শিফাকে হামাস কমান্ড সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করছে দাবি করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল।

বাইডেন বুঝতে শুরু করেন কিছু করার জন্য সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। ১৭ নভেম্বর কাতারের আমিরকে ফোন দেন তিনি, জানান পরের দিন ম্যাকগার্ক কাতারে থাকবেন। সমঝোতা তারা চূড়ান্ত করতে পারেন। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক কর্মকর্তা অবতরণের আগে হামাসের কাছ থেকে সমঝোতার প্রস্তাব পায় কাতার। উভয়েই কথা বলেন সিআইএ প্রধান বিল বার্নসের সঙ্গে। বার্নস নিজের আঞ্চলিক কূটনৈতিক উদ্যোগ জারি রেখেছিলেন। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে প্রধানভাবে যোগাযোগ রাখছিলেন তিনি।

দ্বিতীয় কর্মকর্তা আরও বলেছেন, প্রথম ধাপে নারী ও শিশুদের মুক্তির জন্য সমঝোতা প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে প্রত্যাশা রয়েছে ভবিষ্যতে সব জিম্মিকে মুক্তি করা সম্ভব হবে।

পরের দিন ম্যাকগার্ক কায়রোতে মিসরের গোয়েন্দা প্রধান আব্বাস কামেলের সঙ্গে বৈঠক করেন। তাদের বৈঠকের সময় মিসরীয় পক্ষ একটি বার্তা দেয়: গাজায় হামাস নেতারা আগের রাতে দোহায় নির্ধারিত বিষয়ে রাজি হয়েছেন।

১৯ নভেম্বর ইসরায়েলে আবার যান ম্যাকগার্ক। কথা বলেন ইসরায়েলি যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার সঙ্গে। তাদের কাছে তুলে ধরেন চুক্তি শর্ত এবং হামাসের প্রতিক্রিয়া। ওই সন্ধ্যায় ইসরায়েলের সিনিয়র কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রকে জানান, অল্প কিছু ছোটখাটো পরিবর্তন করলে তারা চুক্তিতে সম্মতি দেবেন।

কাতার সমঝোতার এই সংস্করণ পাঠায় হামাসের কাছে। দুই মার্কিন কর্মকর্তার মতে, কাতারের নেতা হামাস কর্মকর্তাদের জানান, ‘এটিই চূড়ান্ত প্রস্তাব’।

পরের ৪৮ ঘণ্টায় সামান্য কিছু অদল-বদল হয়েছে। কিন্তু স্পষ্ট হয়ে যায় যে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ চুক্তি মেনে নিতে প্রস্তুত আছে। ২১ নভেম্বর সবুজ সংকেত দেয় হামাস। বাকি ছিল ইসরায়েলের মন্ত্রিসভার অনুমোদন। গোপন সেলের সবাই ধারণা করছিলেন, এটি অনুমোদন পাবে।

২১ নভেম্বর রাতের দিকে চুক্তির বিষয়ে সমঝোতার খবর আসে ওয়াশিংটনে। প্রথম মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, এটি ছিল পাঁচ সপ্তাহের যন্ত্রণাদায়ক প্রক্রিয়া।

জিম্মিদের মুক্তির জন্য পুরো প্রক্রিয়া চললেও এতে জড়িতদের ভাবনায় মানুষের মৃত্যুর বিষয়টিও ছিল। ওই কর্মকর্তা আবিগাইলের কথা স্মরণ করে বলেন, এমন পরিস্থিতিতে তিন বছরের একটি মেয়েকে আমি কল্পনা করতে পারি না।

সূত্র: পলিটিকো